পাল বংশ
গোপাল (৭৫০ - ৭৭০ খ্রিস্টাব্দ):
- গোপাল পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
- খালিমপুর তাম্রশাসনে লেখা আছে তাঁর পিতার নাম ছিল বপ্যাট (‘শত্রু বিনাশকারী’)এবং পিতামহ ছিলেন দয়িতবিষ্ণু(সর্ববিদ্যা বিশুদ্ধ )। তাঁদের নামের আগে কোনো রাজকীয় উপাধি ছিলো না।
- গোপালের পত্নী দদ্দাদেবী পূর্ববঙ্গের ভদ্রবংসের কন্যা ছিলেন।
- দেবপালের মুঙ্গের লিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
- খালিমপুর লেখতে তাঁকে ‘পরম সৌগত’ বলা হয়েছে।
- তিব্বতিয়ো পণ্ডিত লামা তারানাথ বলেন যে গোপাল ওদন্তপুরি বিহার নির্মাণ করেন ।
- বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিত তাঁর সমসাময়িক ছিলেন।
ধর্মপাল (৭৭০- ৮১০ খ্রিস্টাব্দ):
- গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র, সুদক্ষ যোদ্ধা ও কূটনীতি বিদ ধর্মপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন( ৭৭০ খ্রি. )।
- হর্ষবর্ধনের মৃত্যুতে উত্তর ভারতে রাজনৈতিক শূনত্যা দেখা দিলে তিনটি শক্তি আর্যাবর্তে প্রাধান্য স্থাপনের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। এই তিনটি শক্তি হলো বাংলার পাল বংশ, মালবের গুর্জর প্রতিহার বংশ এবং দাক্ষিনাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ। তিনটি শক্তির মধ্যে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ‘ত্রি শক্তি যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
- ভাগলপুর-এ প্রাপ্ত নারায়ণ পালের তাম্রপট থেকে জানা যায় ধর্মপাল কনৌজের সিংহাসন থেকে ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করে নিজ মনােনীত চক্ৰায়ুধকে বসিয়ে দেন ।
- প্রয়াগের কাছে যুদ্ধে প্রতিহাররাজ বৎসরাজ ধর্মপালকে পরাজিত করেন । তবে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবর হাতে বৎসরাজ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান এবং রাষ্ট্রকূটরাজ দাক্ষিণাত্যে ফিরে যান । ধর্মপাল উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব ফিরে পান ।
- বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট প্রতিহার সিংহাসনে আরােহণ করে প্রথমে চক্ৰায়ুধকে পরাজিত করে কনৌজ দখল করেন এবং মুঙ্গেরের কাছে এক যুদ্ধে তিনি ধর্মপালকেও পরাজিত করেন । কিন্তু দ্বিতীয় নাগভট্ট রাষ্ট্রকুটরাজ তৃতীয় গােবিন্দর হাতে পরাজিত হয়ে স্বরাজ্যে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন । ধর্মপাল ও চক্ৰায়ুধ বিনা যুদ্ধে তৃতীয় গােবিন্দের কাছে নতিস্বীকার করে তাঁর মিত্রতা লাভ করেন । রাষ্ট্রকুটরাজ দাক্ষিণাত্যে চলে গেলে ধর্মপাল উত্তর ভারতে কর্তৃত্ব ফিরে পান ।
- রাষ্ট্রকূট রাজকন্যা রান্নাদেবীকে ধর্মপাল বিবাহ করেন।
- গুজরাটি কবি সোঢঢল তাঁকে ‘উত্তরা – পথস্বামীন’ বলে অভিহিত করেছেন।
- খালিমপুর তাম্র শাসনে ধর্মপাল কে ‘ভদ্রাত্মজ ‘ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
- তাঁর উপাধি ছিলো ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’।
- তিনি মগধে বিক্রমশীলা মহাবিহার ও সোমপুরী বিহার স্থাপন করেন।
- বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত হরিভদ্র তাঁর গুরু ছিলেন। গর্গ নামে জনৈক ব্রাহ্মন তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
দেবপাল( ৮১০-৮৫০ খ্রি. ) :
- ধর্মপালের মৃত্যুর পর তাঁর যোগ্য পুত্র দেবপাল সিংহাসনে বসেন ( ৮১০ খ্রি. )।
- দেবপাল ছিলেন পাল বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ।
- তিনি মুঙ্গেরে নতুন রাজধানী নির্মাণ করেন।
- প্রথমে তিনি উৎকল দেশ আক্রমণ ও জয় করেন ।
- আসামের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে আসামকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেন ।
- তিনি গুর্জর – প্রতিহাররাজ প্রথম ভােজ এবং রাষ্ট্রকুটরাজ অমােঘবর্ষকে পরাজিত করেন।
- দেবপালের সেনাপতি ছিলেন লবসেন বা লৌসেন ।
- তাঁর মন্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্মণ দর্ভ পানি ও তাঁর পৌত্র কেদার মিশ্র।
- কেবলমাত্র ভারতেই নয়, ভারতের বাইরে সুবর্ণদ্বীপ অর্থাৎ সুমাত্রা, যবদ্বীপ ,মালয় দ্বীপ পর্যন্ত তাঁর খ্যাতি বিস্তৃত হয়। জাভা ও সুমাত্রার শৈলেন্দ্র বংশীয় রাজা বাল পুত্র দেব নালন্দায় একটি বৌদ্ধ মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য দেবপালে র কাছে পাঁচটি গ্রাম ভিক্ষা করেন এবং দেবপাল তা মঞ্জুর করেছিলেন।
- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পৃষ্ঠ পোষকতা অর্জন করে। তিনি নালন্দা কয়েকটি মঠ ও বুদ্ধ গয়ায় একটি বিরাট মন্দির নির্মাণ করেন।
- আরব পর্যটক সুলেমান দেবপালের সময়ে বাংলায় আসেন এবং পালবংশকে তিনি 'রুমি' বলে অভিহিত করেন।
- দেবপালের রাজ্যসভা বৌদ্ধকবি ব্রজদত্ত অলংকৃত করেন।
মহেন্দ্রপাল
- দেবপালের মৃত্যুর পর মহেন্দ্রপাল বাংলার সিংহাসনে বসেন।
- মহেন্দ্রপাল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না তবে পাল বংশের কিছু দলিলে মহেন্দ্রপালের নাম উল্লেখ থাকলেও তাঁকে প্রতিহাররাজ প্রথম মহেন্দ্রপাল মনে করা হত। কিন্তু ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে জগজিবনপুর তাম্রলিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পর মহেন্দ্রপালকে পাল বংশের স্বতন্ত্র রাজা হিসাবে গণ্য করা হয়।
- তাঁর সেনাপতি ব্জ্রদেব নন্দাদির্গিকা-উদরঙ্গ মহাবিহার তৈরি করার জন্য জমি দান করেন।
মহেন্দ্রপালের মৃত্যুর পর শূরপাল সিংহাসনে বসেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর জেলায় প্রাপ্ত তাম্রপট থেকে শূরপালের নাম জানা যায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন দেবপালের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন শূরপাল এবং বিগ্রহপাল হয় শূরপালকে সিংহাসনচ্যুত করেন অথবা সিংহাসনে সরাসরি কোনও উত্তরাধিকারী না থাকায় শান্তিপূর্ণভাবে তাকে প্রতিস্থাপন করেছিলেন। বিগ্রহপালের পর সিংহাসনে বসেন নারায়ণ পাল।
নারায়ণ পাল (৮৫৪-৯০৮ খ্রি.)
- তিনি অকর্মণ্য, অদক্ষ শাসক ছিলেন এবং ধর্মকর্মেই তিনি বেশি মনােনিবেশ করেছিলেন ৷
- রাষ্ট্রকূটরাজ অমােঘবর্ষ এসময় নারায়ণ পালকে পরাজিত করেন এবং তিনি আমােঘবর্যের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন ।
- কলচুরিরাজ কোক্কল বাংলা আক্রমণ করে প্রচুর সম্পদ লুণ্ঠন করেন।
- ওড়িশার রাজা রণস্তম্ভ , রাঢ়দেশের কিছুটা অংশ দখল করেন।
নারায়ন পালের পর সিংহাসনে বসেন যথাক্রমে তাঁর পুত্র রাজ্যপাল, পৌত্র দ্বিতীয় গোপাল ও প্রপৌত্র দ্বিতীয় বিগ্রহ পাল।
প্রথম মহীপাল ( ৯৮৮-১০৩৮ খ্রি. ):
- পাল সাম্রাজ্যের ঘোরতর দুর্দিনে দ্বিতীয় বিগ্রহ পালের পুত্র প্রথম মহীপাল সিংহাসনে বসেন।
- তাঁকে ‘পাল সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা’বলা হয়।
- তার উপাধি ছিল ‘পরমেশ্বর পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ’।
- তাঁর আমলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো চোল রাজা রাজেন্দ্র চোল এর নেতৃত্বে দুই বছর ব্যাপী বাংলার উপর চোল আক্রমণ।
- প্রথম মহীপালের রাজত্ব কালেই উত্তর ভারতে তুর্কি আক্রমণ শুরু হয় এবং সুলতান মামুদ বারংবার ভারতের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েন।সমবেত ভাবে এই আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে আর্যাবর্তের রাজন্য বর্গ ঐক্যবদ্ধ হলেও মহীপাল এই প্রচেষ্টায় সামিল হননি। আসলে তখন তিনি নিজের পিতৃ রাজ্য পুনরুদ্ধারেই ব্যস্ত ছিলেন।
- 1026 খ্রিস্টাব্দে কলচুরিরাজ বাংলা আক্রমণ করে এবং বারানসী দখল করেন।
- তিনি ধর্মবিশ্বাসে বৌদ্ধ ছিলেন। তিনি নালন্দা ও সারনাথে দুটি বৌদ্ধ মঠ ও কাশীতে হিন্দু মন্দির স্থাপন করেন।
- শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন তার সমসাময়িক বৌদ্ধ পণ্ডিত।
দ্বিতীয় মহীপাল( ১০৭০-১০৭৫ খ্রি. )
- তৃতীয় বিগ্রহপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল সিংহাসনে বসেন। তিনি তাঁর দুই ভ্রাতা দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপাল কে কারারুদ্ধ করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে বরেন্দ্রভূমির সামন্ত রাজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহ কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে পরিচিত। বিদ্রোহের নেতা ছিলেন দিব্য বা দিব্যক বা দিব্বক।
- সন্ধ্যাকর নন্দী “রাম চরিত” গ্রন্থে এই বিদ্রোহের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
- এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে পাল রাজা দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হন।
বরেন্দ্রীতে ( উত্তরবঙ্গ ) কৈবর্তদের স্বাধীন শাসন শুরু হয় । দিব্যর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা রুদ্রক এবং রুদ্রক এর পর তাঁর পুত্র ভীম সিংহাসনে বসেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় মহীপাল এর মৃত্যুর পর রামপাল সিংহাসনে বসেন।
রামপাল ( ১০৭৭-১১৩০ খ্রি. )
- রামপাল বরেন্দ্রভূমি পুনরুদ্ধারে সামন্ত রাজাদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ‘রামচরিত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি ভূমি ও ধন সম্পদের দ্বারা তাঁদের বশীভূত করেন। তাদের সাহায্যে একটি শক্তিশালী সেনাদল গঠন করেন। যুদ্ধে কৈবর্ত নায়ক ভীম পরাজিত ও নিহত হন। বরেন্দ্র ভূমির উপর পালদের কর্তৃত্ব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- তিনি রামাবতী নামে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন।
- তিনি ছিলেন পাল বংশের সর্ব শেষ উল্লেখযোগ্য নরপতি।
- রামপাল পাল সাম্রাজ্যের লুপ্ত গৌরব কিছুটা ফিরিয়ে আনলেও তাঁর মৃত্যুর পর সাম্রাজ্য দ্রুত পতনের দিকে অগ্রসর হয়। ১১৬২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পাল বংশের পতন ঘটে।
তাঁর উত্তরসূরি কুমারপাল, তৃতীয় গোপাল, ও মদনপাল দুর্বল শাসক ছিলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর মধভাগে পাল সাম্রাজ্যের পতন হয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- পাল রাজারা নিজেদের সূর্যবংশীয় বলে দাবী করেছেন।
- খোল নামে একশ্রেণীর কর্মচারী গুপ্তচরের দায়িত্ব পালন করতো।
- পাল যুগে পাঁচ রকম কর বা রাজস্ব প্রচলিত ছিল- ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য ও উপরিকর।
- পাল যুগে বাংলাদেশ এ সংস্কৃত রচনার ক্ষেত্রে “গৌরীয় রীতি”-র আবির্ভাব হয়।
- এই যুগেই প্রখ্যাত পণ্ডিত ও রাজনীতি বিদ ভবদেব ভট্ট, দায়ভাগ রচিত জিমূতবাহণ এবং রামচরিত রচয়িতা সন্ধাকর নন্দী আবির্ভূত হন।
- আয়ুর্বেদ দীপিকা, ভানুমতী , শব্দচন্দ্রিকা, চিকিৎসা সংগ্রহ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা চক্রপানি দত্ত এ সময়েরই মানুষ ছিলেন।
- বিতপাল ও ধীমান ছিলেন এই যুগের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর।
- রামপালের আমলে রচিত অস্ট সহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতা গ্রন্থের চিত্র গুলি তৎকালীন চিত্রশিল্পের উল্লেখ যোগ্য নিদর্শন।